রণজিৎ সরকার: এক বছর দুই মাস সুপা আর সজল সেপারেশনে ছিল। দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যস্থতায় আবার তারা সংসার শুরু করে। ক্যাম্পাস লাইফের ফার্স্ট ইয়ার থেকে ওদের প্রেম শুরু। কর্মজীবনে এসে দুজন সংসার গৃহে প্রবেশ করে। সেপারেশনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে একা থাকার দিনগুলোতে সুপা অনেক কিছু ভেবেছে। শেষ ভাবনা ছিল, মানব জীবন একটাই, আধুনিক যুগ হলেও বিয়ে আমার জীবনে একটাই।
সুপাকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি সজল। সে ভেবেছে সুপা যেন তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা না করে। এ ভাবনাটাই ভেবেছে সজল।
সুপা যে কারণে সেপারেশনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ সজলের সহকর্মী রচনার সাথে পরকীয়া। সুপা পরকীয়া প্রেমের কথা জানার পর অনেকবার বুঝিয়েছে সজলকে। কিন্তু বোঝাতে গেলেই ঝগড়া বিবাদ লেগে যেত। এমনকি সুপাকে মানসিক ও শরীরিক নির্যাতন করত সজল।
কথায় আছে না- কয়লা ধুলে ময়লা যায় না, আর মানুষ না মরলে মানুষের স্বভাব যায় না, সজলের স্বভাব যায়নি। সজল এখনো পরকীয়ায় লিপ্ত।
সুপা দ্বিতীয়বার সংসার যাত্রায় সজলের পরকীয়া টের পায়, সজলকে আবার বোঝায় কিন্তু সজল কিছুতেই বোঝে না, নানা ভাবে মিথ্যা কথা বলে। সজল যে মিথ্যা কথা বলে, সুপা তা ভালো করে জানে। তবুও সে ধৈর্য ধরে সজলকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য পরকীয়া প্রেম থেকে সরে আসতে বলত সুপা। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে নিজের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করায় সুপার উপর বিরক্ত হয়ে যায় সজল। সুপা প্রতিবাদ করলে আগের মতোই নির্যাতন শুরু করে। সুপা ধৈর্য হারা হয়ে যায়। ভালো বাসায় দুটি মানুষের জীবনে ভালোবাসাহীন ভাবে সংসার চলতে থাকে।
সুপা যখন সেপারেশনে ছিল তখন হতাশায় নিজের শরীরের প্রতি অবহেলা আর যত্নের করার ফলে তার শরীরে অনেক রোগের দেখা দিয়েছে, এর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। শরীরে ওজন বেড়ে গেছে, মোটা হয়েছে। সজল যখন বুঝতে পারল সুপার শারীরিক সমস্যা, তখন মনে মনে ভাবে সন্তানের মুখ দেখতে পারবে না। বাবা হতে পারব না। বাবা ডাক শুনতে পারব না। এমন বউ ঘরে রেখে কি লাভ! সন্তানের বাবা ডাক শুনতে হলে বিয়ে আমাকে আরও একটা করতেই হবে। সুপার দুর্বলতার দিকগুলো নিয়ে নানা কথা বলে সজল। সুপার কোন কথা সহ্য করতে পারে না সজল। কিছু বললেই সুপার উপর নির্যাতন শুরু করে।
সুপা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দুজনের যেন আবারও তেল-বেগুন সম্পর্ক। সুপার যদিও রাগ বেশি। তাই সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইয়োগা করে। তবুও সে কোনো ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ সজলের আচার ব্যবহার অত্যন্ত বাজে হয়ে গেছে। সুপার রক্তে মাংসে গড়া শরীরে কি করে এত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে পারে!
সজল নেশা করে বাসায় এসেছে, সুপা বুঝতে পারল সজল আজও নেশা করেছে। তাই সে ধীরে ধীরে বলল, ‘তুমি আজও নেশা করে এসেছ?’
শরীর ঢোলাতে ঢোলাতে সজল বলল, ‘তাতে তোর বাপের কি!’
মুক্তিযোদ্ধা বাবার উপর অসন্মানজনক কথা শোনা মাত্র নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না সুপা। শরীরে তাজা রক্ত টগবগ করতে লাগল।
সুপা রাগে বলল, ‘আমাকে মারধর নির্যাতন করো আমি সহ্য করেছি। কিন্তু তুমি আমার বাবাকে তুলে এতবড় কথা বললে। তোমার সাহস তো কম না!
সজল বড় বড় চোখ করে বলল, ‘আমার সাহসের কি দেখছিস!’ এ কথা বলে সুপাকে থাপ্পর মারতে থাকে সজল। থাপ্পর মারতে মারতে বলল, ‘তুই আমার বাসা থেকে চলে যা। তোকে বাসায় রেখে কি করব। তুই তো আমার বংশের বাত্তি জ¦ালাতে পারবি না। তোকে বাসায় রাখা আর কাজের বুয়াকে বাসায় রাখা সমান।
সুপা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে থাকে। কালবৈশাখীর মতো তার মাথার ভেতর ঝড় বইয়ে থাকে। নিজেকে কোনো ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পুরো পৃথিবী ঘুরছে। তাই সে রাগের মাথায় বাসার অনেক কিছু ভেঙে ফেলে। দুঃখে কষ্টে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। বাসার জিনিস নষ্ট করাতে সজল আবারও তাকে চুল ধরে মারতে থাকে। বাসায় একমাত্র আছেন সজলের মা। কিন্তু তিনি সুপাকে বকাবকি করেন। সুপা মনে হয়েছে নরককুণ্ড থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কান্নাকাটি করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের জরিনা ভাবি টের পান। সুপাকে বাইরে যেতে মানা করেন। তবুও সুপা বের হয়ে যায়। জরিনা ভাবী সজলের রুমে গিয়ে দেখে অনেক কিছু ভাঙা। সজলের সাথে কোনো কথা না বলে রুমে থেকে বের হয়ে সুপার খালা শাপলাকে ফোন করে সব বলে দেয়। সজলের বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরেই থাকেন সুপার খালা। আগে সুপা আর সজল ঝগড়া হলে মীমাংসা করে দিতেন খালা।
সুপার খালা ওদের আত্মীয়-স্বজন যারা ঢাকায় থাকে তাদের ফোন করে সবাইকে ঘটনাটা বলে দিলেন।
সুপার খালা পুত্রবধূ পূর্ণিমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, বউমা সুপা কোথায় যেতে পারে? আমাদের বাসায় কি আসবে?’
পূর্ণিমা বললেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মা। কোথায় যেতে পারে এত অল্প সময়ের মধ্যে। আমাদের বাসায় আসতে পারে। সুপা আপুর কাছে তো দুটো মোবাইল আছে। একটা বন্ধ পাচ্ছি। অন্যটা দেখি খোলা পাই কি না। কল দিয়ে দেখি। অন্য নম্বরটা অবশ্য অনেকেই জানে না। সুপা যখন সেপারেশনে চলে গেল তখন রাজু নামের একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়, সে নাকি সুপাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে। তার সাথে ওই নম্বর দিয়ে কথা বলেছে। রাজু নাকি তার ভালো বন্ধু।’
খালা বললেন, ‘ওই রাজু ছেলেটা। ছেলেকে তার বউ ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। ও একটা শয়তান ছেলে। তার আশ্রয় পেয়েই তো সজলের সাথে এমন হয়েছে। সুপার মাথাটা নষ্ট করে দিয়েছে ওই রাজু। চাপাবাজি আর মিথ্যা স্বপ্ন সজলের সম্পর্কে নানা রকমের খারাপ কথা বলে সুপার মনটা নষ্ট করে দিয়েছে। সজলও জানে ওই ছেলের কথা। সুপার সাথে তার ভালো সম্পর্ক। তার কারণেই তো এত কিছু। রাজু মিথ্যা মিথ্যা স্বপ্ন দেখাত সুপাকে। সুপা যখন রাজুকে বুঝতে পারল, সে একটা বাটপার, চাপাবাজ তখন সে দূরে আসতে থাকল অবশেষে সজলের কাছেই ফিরে এলো।’
‘ঠিক কথা বলেছেন মা। আমি অনেক বার বলেছি। তোমার মতো মেয়ে হয়ে ডিভোর্স ছেলের সাথে তুমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাও। ফেসবুকে ছবি দাও। এমন ছবি দেখে মানুষজন কীভাবে। এটা কিন্তু তোমার ঠিক হচ্ছে না। যে কোন সময় তোমাকে বিপদে পড়তে পারে রাজু।’
-তুমি ঠিক পরামর্শ দিয়েছ বউমা। আমিও অনেক বার বলেছি, রাজুর কথা। রাজু থেকে দূরে চলে আয়। তুমি এটাও জানো, সুপার এত কিছু জানার পরও রুবেল নামে একটা ছেলে সুপাকে গভীরভাবে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসে। তুমি কি রুবেলকে চেন?’
-হ্যাঁ, সুপার মুখ থেকে আমি রুবেলের কথা অনেক বার শুনেছি। ছেলেটা ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত শৃষ্ট ও মেধাবী। সুপার অনেক উপকার করেছে। এ জগতে এমন ছেলে পাওয়া কঠিন।’
-তা ঠিক বলেছ। আমিও তাকে ভালো করে চিনি, জানি। সুপা রুবেলের প্রশংসা করে সব সময়।
-মা তাহলে তো রুবেলকে ফোন দেওয়া যায়। সুপা কোথায় আছেন, তা হয়তো রুবেলকে বলতে পারে।’
-রুবেলকে ফোন দেওয়া যাবে না। কারণ এই মুহূর্তে রুবেলের সাথে সুপার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কারণ অন্য একটা কারণে সুপা রুবেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। রুবেল অনেক কিছু জানলেও কিছু কিছু তথ্য জানে না। তুমি সুপাকে আগে ফোন করো।’
খালার ছেলে বাবুল বললেন, ‘মা এসব চিন্তা এখন বাদ দাও। আমাদের বাসা থেকে ওর বাসা মাত্র দশ মিনিটের পথ। আমাদের বাসায় হয়তো ও আসবে না। ঘটনার এত সময় পর চলে আসত। কোনো বান্ধবীর বাসায় গেল কি না। সুপাকে কল কর।’
খালা কল করল। কিন্তু রিং হয়। কল ধরে না সুপা। অনেক কয়েক বার কল হলো। কিন্তু অবশেষে কল ধরল। তারপর ওর খালা বললেন, ‘তুই কোথায় সুপা?’
সুপা রাগে বলল, ‘আমি জাহান্নামের চৌরাস্তায়…। আর কোন কথাই বলে না। ওরা খালা তার পুত্র আর পুত্রবধূকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো সুপার খোঁজে। মোবাইলের লোকেশন দেখে বুঝতে পারল সুপা কোথায় আছে। আশপাশেই আছে।
বাসা থেকে বের হয়ে ধানমন্ডি লেকের পাশে বসে আছে সুপা। সুপা বসে বসে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি দেখছে আর ভাবছে- বঙ্গবন্ধুর সপরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা এখন এতিম। আমিও বাবা মা ছাড়া এতিম। আসলে গোলাকার পৃথিবীর মতো আমি বড় একা!
সুপার পাশে গিয়ে ওরা দাঁড়াল। তারপর সুপাকে ওরা বাসায় নিয়ে এলো। শরীরে আঘাতের জায়গায় ডাক্তার দম্পতি সুপার পরিচর্চা করতে লাগল।
রাতে আর কোনো কথা বলে না। সজল সুপার খালাকে ফোন দেয়।
-সুপা কি আপনার বাসায়?’
-হ্যাঁ। সুপাকে যদি না পেতাম তাহলে তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াতাম।’ এই বলে রাগে ফোনটা কেটে দেয় শাপলা খালা। এমন সময় সুপা খালাকে বলে, খালা ফাইনাল একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি আর এভাবে সজলের সাথে সংসার করতে পারব না।
-তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। আমি দেখি। আজ এ বিষয়ে তোর সাথে কথা বলব না এখন। চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে খেয়ে অন্য কাজ কর।
পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার জন্য সবাই মিলে লুডু খেলতে লাগল।
পরদিন সকালে সজল সুপার খালার বাসায় এসে বলে, ‘খালা, আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দেন। সুপাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাই। আর কোন দিন এমন ব্যবহার করব না।’
খালা বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি আর কিছু বলতে পারব না সজল। সুপা এখন তোমার বাসায় যাবে না। আমি ওর কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে তোমাকে পরে সব বলব।’
-‘ঠিক আছে খালা। আমি তাহলে যাই।’
সজল চলে যায়।
সুপা বুঝতে পারে এটা সজলের অভিনয়। মামলার হাত থেকে বাঁচার জন্য বাসায় এসেছে।
সুপার বিষয় নিয়ে কি করা যায় রাতে আলোচনায় বসল। সুপার খালা বলল, ‘সুপা, তুই কি সজলের সংসারে যেতে চাস?’
-না খালা। মরণের জন্য তার সংসারে যেতে চাই না।
-তুই সুখ চাস নাকি টাকা চাস।
সুপা বলল, ‘সব মানুষতো সুখ চায়। আমি তাই চাই।’
-তাহলে তোকে যে গভীর ভাবে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে কর। তোর তো টাকা-পয়সার অভাব নেই। রুবেল ছেলেটা কিন্তু তোকে প্রচÐ ভালোবাসে এটা আমি বুঝতে পেরেছি। রুবেলকে বিয়ে করলে অনেক সুখী হবি। তুই বিষয়টা ভেবে দেখতে পারিস। কারণ আমি দীর্ঘদিন ধরে ছেলেকে চিনি। তোর সুখের জন্য এমন ছেলে জীবনসঙ্গী দরকার। এমন ছেলেকে হাত ছাড়া করিস না সুপা। যদি রুবেলকে বিয়ে করিস তাহলে ডিভোর্সের কাগজ রেডি করে সজলকে পাঠিয়ে দে।’
-খালা আমিও জানি রুবেল অনেক ভালো ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে চিনি। সব সময় আমার ভালো চায়। আমার অনেক উপকার করেছে। লাখে এমন ছেলে একটাও হয় কি না সন্দেহ আছে। আমার জীবনের দুঃখের কথা শুনে অনেক আগেই আমাকে বিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে রুবেল। আমি এত দিন না করেই আসছি।’
খালার বউমা বলেন, ‘আপু, তোমার জন্য রুবেল ছেলেটা অনেক ভালো হবে। কারণ আমাদের বাসায় তো সে অনেক বার এসেছে। আমি দেখিছি। কথা বলেছি। তুমি মনে হয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবা।’
খালার ছেলে বাবুল বলে, ‘ডিভোর্সের আগে রুবেলের সাথে কথা বল। ডিভোর্স দিলে তোকে বিয়ে করবে কি না।’
খালা বললেন, ‘বাবুল ঠিক বলেছে। কোনো চিন্তা করিস না। বাকিটা আমি রুবেলের সাথে কথা বলব। আগে সজলের সাথে ডিভোর্সের কাজটা শেষ করতে হবে। এর মাঝে সুপা রুবেলের সাথে কথা বলে সব ঠিক করবে। তারপর বিয়ের আয়োজন।’
-ঠিক আছে।
কয়েক দিন পর সজলকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিল সুপা। এদিকে রুবেলকে সময় দিতে লাগল সুপা। সুপা আবার এবার রুবেল সাথে গভীর ভাবে প্রেমে পড়ে গেল। তিন মাস পর ডিভোর্স কার্যকর হলো। ছয় মাস পর সুখের আশায় সুপা আর রুবেল বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করল…
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সূএ: জাগো নিউজ